ফুটবল ফিরুক বাংলার উঠানে




বাংলায় ক্রিকেটে সাফল্যের পূর্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল ফুটবলের এর পিছনে যৌক্তিক কারণ হচ্ছে বাংলার ফুটবলে তখন ধারাবাহিক সাফল্য ছিল। মানুষ মেতে থাকতো ফুটবল উন্মাদনায়। গ্রামের ধানক্ষেত,  উঠান থেকে শুরু করে শহরের অলিগলিতে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আবহাওয়ার যেকোনো পরিস্থিতিতে হোক রোদ কিংবা বৃষ্টি বিনোদনের অনুসঙ্গ ছিল ফুটবল। 



গ্রামে গ্রামে এখনো অনুষ্ঠিত হয় ফুটবল টুর্নামেন্ট যেগুলোর জনপ্রিয়তার কথা প্রায়ই উঠে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফুটবলের প্রতি গ্রাম-গঞ্জের এই জনপ্রিয়তা, উপচে পড়া ভীড়গুলো ফুটবলের সোনালী অতীতকেই যেন মনে করিয়ে দেয়। শহুরে বা শিক্ষিত প্রজন্মের  বেশিরভাগই সারা বছর মেতে থাকে ইউরোপ কিংবা লাতিন আমেরিকার ফুটবল ক্লাবগুলো নিয়ে। এই বিশাল ফুটবলপ্রেমীদের কথা মাথায় রেখে বাফুফে তৃণমূল ফুটবল, স্কুল-কলেজ ফুটবলে মনোযোগী হয়ে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের ফুটবল গৌরব ফিরবেই। 


এ প্রজন্মের অনেকেরই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শুনা হয়, আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা। যার রেষারেষি মাঠ ছাপিয়ে মাঠের বাইরেও এসে পড়তো প্রায়ই। হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াতো দু'দলের সমর্থকদের উন্মাদনা। 


স্টেডিয়াম ভরে উঠতো সকল শ্রেণি পেশার ফুটবল ভক্তের সমর্থনে। দেশের প্রবীণ নাগরিকদের অনেকেই আজো স্মৃতির পাতায় হাতড়ে বেড়ান সেদিনের সেই স্মৃতিগুলো। রোমন্থন করার চেষ্টা করেন, ডিফেন্ডার মোনেম মুন্না ঢাকার মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।  যে ছিল সে সময়কার উপমহাদেশের সেরা ডিফেন্ডার। কাজী সালাউদ্দিন, নওশের, অমলেশ সেন, বাদল রায়, মনোয়ার হোসেন নান্নু, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, ওয়াসিম ইকবাল, আশিষ ভদ্র, সালাম মুর্শিদির মতো ধারাবাহিক পারফর্মাররা জ্বলে উঠছেন হোক সেটা ক্লাব কিংবা জাতীয় ফুটবল।


স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালে কুয়ালালামপুরের আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচেই বাজিমাত দু'বছর আগে স্বাধীন হওয়া নবীন বাংলাদেশের। সেদিন বাংলাদেশ থাইল্যান্ডকে ২-২ গোলে রুখে দিয়ে জানান দিচ্ছিল ফুটবলে নব্যশক্তির আগমনের বার্তা। আশির দশকে মালদ্বীপকে ৮-০ গোলে হারানোর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল পরাশক্তি। টানা তিনবার সাফ ফাইনাল খেলা এবং ২০০৩ সালে ভারতকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নস হওয়া দলটি হারালো কই? বাফুফের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাই ফিরিয়ে দিতে পারে বাংলার ফুটবলের সোনালী সে দিনগুলোকে।



অনেকেই বলে থাকেন ক্রিকেট জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে ফুটবল। ব্যাপারটা তা না, কোনো খেলার জনপ্রিয়তা কোনোভাবেই অন্য খেলাকে প্রভাবিত করে না। বাংলার ফুটবলের ধারাবাহিক ব্যার্থতাই খুইয়েছে তার জনপ্রিয়তাকে। সাম্প্রতিক সময়ে জামাল ভূঁইয়াদের হাত ধরে যে সাফল্য আসছে, প্রতিদ্বন্দিতামূলক ফুটবল উপহার দিচ্ছেন তারা। সে সাফল্য নিয়ে নানা কাটাছেঁড়া বা সমালোচনা হচ্ছে দেশের ক্রীড়ামোদীমহলে ঠিকই। ভালো ফুটবল দর্শকদের স্টেডিয়ামে আনাগোনা বাড়াচ্ছে যা ফুটবলেরই সাফল্যের ফল। বাংলাদেশের মানুষ ভীষণ ক্রীড়া প্রেমী যার ফলে স্পোর্টসের যে ফরম্যাটেই সফল হোক বাংলাদেশ, তা নিয়ে মেতে থাকবেই ক্রীড়াপ্রেমী আপামর জনগন। ফুটবল পাগল এ জাতি যে এখনো ফুটবল ভুলেনি চারবছর পরপর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপফুটবলের সময় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা ফুটবলের অন্য পরাশক্তিগুলোকে সমর্থনের মধ্যদিয়েই বুঝা যায়। সকল বাংলাদেশী ফুটবল সমর্থকদের মনে তখন একটাই প্রশ্ন জাগে, কবে বাংলাদেশ ফুটবল বিশ্বকাপ খেলবে?


বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাইপর্বগুলোতে ক্রীড়া নৈপূন্যে আবারো মেতে উঠছেন দেশের সকল শ্রেনীর ফুটবল সমর্থক। কলকাতার সল্টলেকে ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা  ম্যাচ শেষে হয়েছিল ১-১ ড্রয়ের মধ্যদিয়ে। আবারো গতকাল (৩ জুন) আফগানিস্তানের সাথে ভালো ফুটবল উপহার দিয়েছেন জামাল ভূঁইয়ারা। ম্যাচের প্রথমার্ধে কোনো দলই গোলের দেখা পায়নি। বিশ্বকাপ এবং এশিয়াকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল পায় আফগানরা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আনওয়ার শরিফের ডি-বক্সে ডানদিকে পাওয়া বলের নিখুঁত শটে। ম্যাচের বয়স যখন ছিল ৪৮ মিনিট। হারের শঙ্কা পেয়ে বসে বাংলাদেশকে কিন্তু ৮৪ মিনেটের সময় তপু বর্মনের গোলে ম্যাচে ফিরেন বাংলাদেশ। বল দখলে এগিয়ে থাকলেও জামাল ভূঁইয়া, তারিক কাজীদের রক্ষণকে পরাভূত করতে পারে নাই আফগানিস্তান ফুটবলাররা। 


বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় কাতারের দোহায় জাসিম বিন হামাদ স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নামে বাংলাদেশ। 


জেমি ডের শিষ্যরা ভালো ফুটবল খেলতে শুরু করেছে, এখন শুধু দরকার ধারাবাহিকতার। ১৯৯৬ সালে র‍্যাঙ্কিংয়ে ১১০ এ থাকা দলটির অবনমন ১৯৭ এ গিয়ে ঠেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভালো ফুটবল উপহার দিয়ে সামনে এগোচ্ছে বাংলাদেশ যা এখন ১৮৪ তে। ভালো খেলার বদৌলতে মাঠে আবারো দর্শকের উপস্থিতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এখন পেয়েছে জামাল ভূঁইয়ার মতো অধিনায়ক-মিডফিল্ডার এবং জেমি ডে’র মতো কোচ। বিপলু, সাদ, ইব্রাহিম, ইয়াসিন, তপু বর্মন, তারিক কাজীদের মতো লড়াকু ফুটবলার। বাংলাদেশের ফুটবলের নবজাগরণে প্রয়োজন নিয়মিত ঘরোয়া ফুটবল আয়োজন। নতুন খেলোয়াড়ের খুঁজে নিয়মিত স্কুল-কলেজ ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। ফুটবল সংগঠকদের আরো বেশি জোড়ালো ভূমিকা রাখতে হবে।


ফুটবল সংশ্লিষ্ট সকলের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে ফিরে আসবে অতীতের ফুটবল, এমনটাই প্রত্যাশা সকল ফুটবল সমর্থকদের।